খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার সবার। পৃথিবীতে ক্ষুধাই এখনও মানুষকে আদিম জীবনে বেঁধে রেখেছে। যদিও ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষ বা অপুষ্টির কারণ এখন আর খাদ্যের অভাব নয়। বরং মানুষ খাদ্য কেনায় ব্যর্থ, বা সরাসরি বললে দারিদ্র্যই এর কারণ।
আর এজন্যই খাদ্যের দাম ওঠানামার সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতাও কমে বাড়ে। এমনকি লেগে যায় দাঙ্গাও। ২০০৭-০৮ সালে বিশ্ব জুড়ে খাদ্যের দাম একলাফে বেড়ে যাওয়ার পর আফ্রিকার একটা বড় অংশে যেমন লেগেছিল খাদ্যদাঙ্গা।
তথ্য বলছে, বিশ্বের জনসংখ্যা ৬৬০ কোটি। তার মধ্যে প্রায় ৪০০ কোটি গরিব, বা দারিদ্র্যসীমার আশপাশে ঘোরাফেরা করেন। এরা খাদ্যের বাজারে প্রায় ঢুকতেই পারেন না৷ খাদ্য কেনার ক্ষমতা এদের খুবই কম। এদের মধ্যে ১০০ কোটি আবার চরম খাদ্যাভাবে ভোগেন৷ খাদ্য পদবাচ্য জিনিস এরা সারা জীবনে চোখেই দেখতে পান না৷। অন্যদিকে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর যে পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন হয় তা বছরে প্রায় ১২০০ কোটি মানুষের ক্ষুধা দূর করার পক্ষে যথেষ্ট।
তাহলে অঙ্কটা কী দাঁড়াল? ২৬০ কোটির জন্য বরাদ্দ ১২০০ কোটির খাবার৷ নে, কত খাবি খা! গরিব দেশে প্রতি বছর প্রায় ১ কোটি মানুষ মারা যান চরম অপুষ্টির জন্য৷ আর ধনী ও উন্নয়নশীল দেশে ১২০ কোটি মানুষ ক্রমশ মোটা হয়ে যাচ্ছেন৷ সেখানে বেশ ভাল চলছে রোগা হওয়ার ব্যবসা৷। ভাবলে অবাক হতে হয়।
টাকা থাকলেও একজন কত খেতে পারেন? খাওয়ার পেছনে কত টাকা খরচ করতে পারেন? তাহলে বাকি খাবার কী হচ্ছে? কেন, নষ্ট হচ্ছে! একদিকে কিছু দেশে যখন চরম খাদ্যসঙ্কট, দাঙ্গা লেগে যাচ্ছে, ক্ষুধার সূচক ‘অ্যালার্মিং’ বা ‘এক্সট্রিমলি অ্যালার্মিং’ তখন অন্য দেশ প্রচুর খাবার ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে।
ইংল্যান্ড প্রতি বছর যে পরিমাণ খাদ্য সংগ্রহ করে তার এক-তৃতীয়াংশই নষ্ট করে৷ এর মূল্য ১০.২ বিলিয়ন পাউন্ড বা ১,০২,০০০ কোটি টাকা। আমেরিকা প্রতি বছর গড়ে ৩৫০ বিলিয়ন পাউন্ড খাদ্য সংগ্রহ করে৷। এর মধ্যে ১০০ বিলিয়ন পাউন্ড খাদ্যই নষ্ট হয় খুচরো বিক্রেতা, রেস্তোরাঁ বা ক্রেতাদের হাতে।
সুইৎজারল্যান্ড যে বিরাট ধনীদের দেশ সেটা নতুন তথ্য নয়৷ কিন্তু সেখানকার বড়লোকদের খাওয়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় গমের ৮০শতাংশ যে ভারত রপ্তানি করে সেটা জানা ছিল কি? এদিকে দেখুন, ভারতেই ২০ কোটি মানুষ ভয়ানক অপুষ্টির শিকার৷ অথচ সুইডেনের হিসেব বলছে, মোট খাদ্যের এক-চতুর্থাংশ ফেলে দেয় তারা।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে যে কমন ফিশারিজ পলিসি রয়েছে, সেই অনুযায়ী ধরা মাছের ৪০শতাংশ থেকে ৬০শতাংশ তারা প্রতিদিন মৃত অবস্থায় সমুদ্রে ফেলে দেয়৷ আগে আমেরিকাও প্রতি বছর অতিরিক্ত খাদ্য নাকি সমুদ্রে ফেলে দেয়। তাতে অনেকে প্রতিবাদ জানিয়েছিল৷ এখন প্রতি বছর প্রচুর খাদ্য তারা গর্ত বোঝাতে ব্যবহার করে।
সরকারি তথ্যই বলছে, খাদ্যই এখন আমেরিকায় খনি ভরাট করতে দ্বিতীয় স্থানে৷ কিন্তু তাতে সমস্যা বাড়ছে৷ কারণ প্রচুর পরিমাণ মিথেন গ্যাস তৈরি হচ্ছে পচা খাবার থেকে৷ বিশ্ব উষ্ণায়ন, গ্রিনহাউস ইফেক্ট, কার্বন ডাই অক্সাইড নিয়ে এত আলোচনা৷ কিন্তু অনেকেরই খেয়াল থাকে না যে গ্রিনহাউস গ্যাস হিসেবে মিথেন ২৩ গুণ বেশি ক্ষতিকারক।
আগেই বলেছি, বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষ অপুষ্টির শিকার৷ কিন্তু ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকা যে পরিমাণ খাবার ফেলে দেয় তার এক-চতুর্থাংশ দিয়ে এই ১০০ কোটির অপুষ্টি দূর করা যেত।
উন্নত দেশের মানুষ সব বাজারই করেন মল থেকে৷ মলের ‘BOGOF’ (বাই ওয়ান গেট ওয়ান ফ্রি) নীতিও এই অপচয়ের জন্য দায়ী৷ দেখা গেছে, এর জন্যই প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার কিনে ফেলছেন মানুষ, যেটা পরে ফেলা যাচ্ছে৷ তবে ফ্রান্স খাদ্যের অপচয় দূর করতে উদ্যোগী হয়েছে৷ খাদ্যের ক্ষেত্রে মলের ‘বোগফ’ নীতি বাতিল করছে তারা৷ অতিরিক্ত খাদ্য পচে যাওয়ার আগে স্বেচ্ছাসেবী সংস্হার হাতে তুলে দেওয়াও বাধ্যতামূলক হচ্ছে সেখানে৷ তবে সেই খাবারও গবির লোকেদের পেটে যাওয়ার চেয়ে প্রাণীখাদ্য হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
বিশ্বে অপুষ্টির শিকার মোট শিশুর এক-তৃতীয়াংশ ভারতে৷ কিন্তু সমীক্ষা বলছে, শুধু বেঙ্গালুরুতেই বিয়ে উপলক্ষে বছরে ৯৪৩ টন খুব ভাল খাবার নষ্ট হয়৷ অক্ষয় তৃতীয়ার দিন এদেশে বিয়ের ধুম পড়ে যায়৷ ২ বছর আগে অক্ষয় তৃতীয়াতে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্হা জয়পুরের মাত্র ১৬টি বিয়েবাড়ি থেকে যে পরিমাণ অতিরিক্ত খাদ্য সংগ্রহ করেছিল তা দিয়ে তারা পরের দিন ১০,০০০ মানুষকে পেটপুরে খাইয়েছিল।
আগে বিয়েতে ১৫ থেকে ১৬ রকমের পদ হত৷ এখন বিয়ে আবার মাল্টি কুইজিন৷ এখানে ইন্ডিয়ান তো ওখানে চাইনিজ বা লেবানিজ, আবার সেখানে কন্টিনেন্টাল৷ অপচয়ও ‘মাল্টিপ্লাই’ করছে। সমীক্ষা বলছে, বিয়েতে সাধারণত ২০শতাংশ খাদ্য অপচয় হয়৷ বুফেতে বেশি, ২২শতাংশ৷ অথচ ধারণা ছিল বুফে সিস্টেমে খাবারের অপচয় কম হবে৷ কিন্তু মানুষ যা খেতে পারবেন তার চেয়ে বেশি তুলছেন পাতে৷ আগে দেখতাম অনুষ্ঠান বা অন্যত্রও বড়রা ছোটদের উপদেশ দিতেন, পাত পরিষ্কার করে খাবে। এখন আর তেমন উপদেশ বোধহয় কেউ দেন না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে একটি সরকারি পোস্টার জনপ্রিয় হয়েছিল: ‘আ ক্লিয়ার ডিস মিনস ক্লিয়ার কনশেন্স’। এখন আর এমন পোস্টার তৈরি করার কথা কোনও সরকার ভাবেও না৷।
অপচয় মানে তো মৃত্যু। অথচ সেই অপচয়কে উৎসাহ দিতে কী বিস্তৃত কারবার। যেটা এখন খুব চোখে পড়ছে মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে৷ অথচ একদিকে ক্ষুধার সাম্রাজ্য নিয়ে আহা-উহু৷ আফ্রিকার দুর্ভিক্ষ-আক্রান্ত বা ভারতের অপুষ্টির শিকার শিশুদের নিয়ে কতই না আবেগ, উদ্বেগ৷ অন্যদিকে দিব্যি চলছে অনিরুদ্ধ অপচয়ের স্রোত। কারও মাথাব্যথা নেই৷ এই না হলে ‘দি জোমবি ইকোনমি’, মৃতের অর্থনীতি!
নোট : লেখাটি এই সূত্র থেকে নেয়া হয়েছে। লিখেছেন গৌতম মুখোপাধ্যায়। অতীব গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ায় লেখাটি শেয়ার করলাম। ঈষৎ সম্পাদিত।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ
অনেক গুরুত্বপূর্ণ পোস্ট…ধন্যবাদ
আপনাকেও ধন্যবাদ।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
আরও তথ্যভিত্তিক হতে পারতো।
আরও তথ্যভিত্তিক হতে পারতো।
উদাহরণ দিন। কিভাবে
উদাহরণ দিন। কিভাবে তথ্যভিত্তিক করা যায়, তা না বলে তথ্যভিত্তিক হতে পারতো বলাটা হলো অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়া। তাছাড়া লেখাটা আমি লিখিনি। এটা খেয়াল করলে এই মন্তব্য এখানে করার প্রয়োজনও হতো কম। যাই হোক, পরামর্শ দিন।
রাস্টিয় ভাবে নীতি নির্ধারণ
রাস্টিয় ভাবে নীতি নির্ধারণ করা না হলে খাদ্য অপচয় চলতেই থাকবে । ফ্রান্সের খাদ্য নীতি যেটা বললেন সেটা আরেকটু মডিফাই করে উন্নত বিশ্বের দেশ গুলো যদি ফলো করত তাহলে হয়ত অপচয় অনেকটা কমত ।
মজুদ কৃত খাদ্যের কতটুকু অংশ অপচয় হচ্ছে সেই হিসাব যেহেতু প্রত্যেক রাস্টে আছে সেহেতু মজুদের পরিমান কমানোও খাদ্য নীতির আওতাধীন করা উচিত । জিওগ্রাফি চ্যানেলে খাদ্য অপচয় নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি দেখেছিলাম তখন থেকেই এই কথা গুলো মাথায় ঘুরছিল বলার সুযোগ ছিল না । সুন্দর লেখার জন্য কৃতজ্ঞতা
অনেক ধন্যবাদ হিমু ভাই। আসলে
অনেক ধন্যবাদ হিমু ভাই। আসলে ফ্রান্সের প্রক্রিয়াটা একটু বেটার, কিন্তু আগের ধারারই। আমার মনে হয় সার্বিক পুনর্গঠন দরকার।
চমৎকার লেখা।
চমৎকার লেখা।
ধন্যবাদ ভাই। শেয়ার করতে পেরে
ধন্যবাদ ভাই। শেয়ার করতে পেরে ভালো লাগছে।
আপনার লেখা মানেই তথ্য উপাত্ত
আপনার লেখা মানেই তথ্য উপাত্ত সম্বলিত । এইলেখাটা মনে হয় একটু বেশিই সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে!
তবে অলক্ষে ঘটে যাওয়া এই বিষয়টি নিয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ :থাম্বসআপ:
আমার লেখায় তথ্য-উপাত্ত থাকে
আমার লেখায় তথ্য-উপাত্ত থাকে কিনা জানি না। তবে আপনার মন্তব্য যে ভিত্তিহীন, তা বুঝতে পারছি। লেখাটি অন্যের, এবং ঈষৎ সম্পাদনা করে এখানে প্রকাশ করেছি। সেটা লক্ষ্য না করেই তথ্য উপাত্ত নিয়ে বসে গেলেন?
আপনাকেও ধন্যবাদ মতামত দেয়া ও লেখাটি পড়ার জন্য। 🙂
আপনি শেষে লিখেছেন ঈষৎ
আপনি শেষে লিখেছেন ঈষৎ সম্পাদিত! তো ছুরি যখন চালালেন অনে্যর লেখায়, তো আরেকটু বড়সড় ছুরিই চালাতেন! আপনার পূবের্র লেখা সবগুলোই পড়েছি, এবং পড়ি । আর আপনার লেখা পড়ি কয়েকবারে! কারণ বেশির ভাগ দীঘর্ লেখা এবং তথ্য সম্বলিত, সেজন্যই বলেছিলাম ।
ঈষৎ সম্পাদিত মানে এই না যে,
ঈষৎ সম্পাদিত মানে এই না যে, লেখায় নতুন কিছু ঢোকানো হয়েছে। বরং কিছু বাদ দেয়া হয়েছে। লেখা পড়েন জেনে ভালো লাগল। অনেক ধন্যবাদ।
যে পরিমান খাদ্য উন্নত বিশ্বে
যে পরিমান খাদ্য উন্নত বিশ্বে নষ্ট করা হয়, সেই পরিমাণ খাদ্য দিয়েই ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়া সম্ভব। উদ্বৃত্ত খাদ্য দিয়ে খনির খালি জায়গা ভরানো কোন ধরনের মানবতা? ধিক্কার এসব দেশের প্রতি।
এটা হচ্ছে পশ্চিমা সভ্যতার
এটা হচ্ছে পশ্চিমা সভ্যতার নমুনা
উন্নত দেশগুলোর বাড়তি খাদ্য
উন্নত দেশগুলোর বাড়তি খাদ্য দিয়ে দরিদ্র দেশের খ্যাদ্য চাহিদা মেটানো সম্ভব।যুদ্ধ আর লুটেরা নীতি বাদ দিয়ে ওরা আর একটু মানবিক হলেই সবাই ওদের মোড়লগিরি হয়তো মেনে নিত।
আপনি তাহলে মোড়লপনা কি জিনিস
আপনি তাহলে মোড়লপনা কি জিনিস তাই বুঝেননি। যুদ্ধ তথা কর্তৃত্ব না ধরে রাখলে সে কিভাবে মোড়ল থাকবে? আর লুট তথা শোষণ-লুণ্ঠন ছাড়া কিভাবে সে মোড়ল হবে?
এই প্রবন্ধটি সভ্যতা ও উন্নত
এই প্রবন্ধটি সভ্যতা ও উন্নত সমাজের সংজ্ঞা নির্ধারণে আমাদের বিরাট সাহায্য করবে।
একমত
একমত