রোহিঙ্গা আদিবাসী জনগোষ্ঠী পশ্চিম মায়ানমারের (পূর্বের নাম বার্মা) আরাকান (বর্তমান নাম রাখাইন) প্রদেশের একটি উলেখযোগ্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। এরা প্রায় সবাই মুসলমান। ধারনা করা হয়, ১৪০০ শতাব্দীতে প্রথম মুসলমান রোহিঙ্গারা রাখাইন প্রদেশে বসবাস শুরু করে। রোহিঙ্গাদের আলাদা ভাষা থাকলেও তা অলিখিত ছিল। বর্তমানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আধুনিক লিখিত ভাষাই হল রোহিঙ্গা ভাষা।
বর্তমান ২০১২ সালে, প্রায় ৮,০০,০০০ রোহিঙ্গা মায়ানমারে বসবাস করে। মায়ানমার ছাড়াও ৫ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এবং প্রায় ৫লাখ সৌদি আরবে বাস করে বলে ধারনা করা হয়, যারা বিভিন্ন সময় মায়ানমার সরকারের নির্যাতনের কারণে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের তথ্যমতে, রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী।
জাতিসঙ্গের (ইউ.এন.এইস.সি.আর) ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ২ লাখ থেকে ৫ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করছে যার মধ্যে প্রায় ৩২ হাজার ৫ শত শরণার্থী দুটি শরণার্থী শিবিরে নিবন্ধিত। বাকীরা কক্সবাজার এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জে বসবাস করছে।
১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রাখাইন মায়ানমারের স্বাধীন প্রদেশ ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়। এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে এ ভূখণ্ড। ব্রিটিশরা মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কথিত আছে, তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের স্বল্প পরিসরে হলেও প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে।
১৯৮২ সালের নাগরিকত্ব আইনের ফলে তারা নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত হন। তারা সরকারি অনুমতি ছাড়া ভ্রমণ করতে পারে না, জমির মালিক হতে পারে না এবং দুইটির বেশি সন্তান না নেওয়ার অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়।
রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বলা হয় “বিশ্বের সবচেয়ে কম প্রত্যাশিত জনপদ এবং “বিশ্বের অন্যতম নিগৃহীত সংখ্যালঘু”। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অনুসারে, ১৯৭৮ সাল থেকে মায়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গারা মানবাধিকার লংগনের শিকার হচ্ছে এবং তারা প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ, থাইল্যান্ডসহ বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
২০০৫ সালে, জাতিসংঘের ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফুজিস, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল কিন্তু রিফুজি ক্যাম্পগুলোতে মানবাধিকার লংগনের অভিযোগে সেই উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। অন্যদিকে, ২০১২ সালে মায়ানমারে এক বৌদ্ধ নারীকে ধর্ষণ ও হত্যার মূলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে রোহিঙ্গারা জীবনের ভয়ে বাংলাদেশের আশ্রিত ক্যাম্পগুলোতেই থেকে যায়।
ইতিপূর্বে, কিছু রোহিঙ্গা রাজনীতিবিদ মায়ানমারের সরকারের সঙ্গে একটি সমঝোতায় আসতে রাজি হয়েছিল যদি তাদেরকে রোহিঙ্গা বা বাঙালি আখ্যা না দেওয়া হয়। বিকল্পস্বরূপ, ‘রাখাইন মুসলমান’, ‘মায়ানমার মুসলমান’ বা ‘সাধারণভাবে মায়ানমার’ বলে প্রস্তাব রাখা হয়েছিল। একজন রোহিঙ্গা সংসদ সদস্য দাবি করেছে, “রোহিঙ্গারা রাখাইনে বসবাস করছে পৃথিবী সৃষ্টির শুরু থেকেই। আরাকান প্রদেশ আমাদের; এটি ১০০০ বছর যাবত ভারতের ভূমি ছিল”।
মায়ানমারের বৌদ্ধ এবং রাখাইনের মুসলমানদের বা রোহিঙ্গাদের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারন, বর্তমান অবস্থা ‘দি ইকোনিমিস্টে’র এ ভিডিও লিঙ্কটিতে দেখুন-
http://www.economist.com/news/asia/21565638-why-buddhists-and-muslims-rakhine-state-myanmar-are-each-others%E2%80%99-throats-unforgiving
সাম্প্রতিক সময়ে, অগণিত রোহিঙ্গারা নৌকাবাহী মানুষ হিসেবে তাদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছে। কিছুদিন আগে বিভিন্ন দেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানাকৃত শত-শত রোহিঙ্গারা বঙ্গোপসাগরে তাদের নৌকা ডুবে মারা গিয়েছে। যেসব রোহিঙ্গারা এখনও মায়ানমারের রাখাইনে পড়ে আছে তারা তাদের প্রতিবেশী বৌদ্ধ সম্প্রদায় থেকে একঘরে হয়ে আছে। উভয় সম্প্রদায় এখনও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্য দিয়ে সময় কাতাচ্ছে যে আবার যেকোন সময় দাঙ্গা শুরু হতে পারে।
গত বৎসরে, বাংলাদেশ সরকারকে জাতিসংঘ অনুরোধ করেছিল অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় দেওয়ার জন্য। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার সার্বিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তাছাড়া মায়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন অভিবাসন চুক্তিও নেই। বাংলাদেশও একটি উন্নয়নশিল গরীব দেশ। বাংলাদেশ সরকার নিজের দেশের জন বিস্ফোরণকেই সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে।
অন্যদিকে, রোহিঙ্গা শরণার্থীগুলোতে ধারন ক্ষমতার চেয়েও অনেকগুণ অতিরিক্ত, অবৈধ রোহিঙ্গা এসে বসবাস করছে। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন অপরাধ ও অসামাজিকমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটাচ্ছে।
তাদেরকে নিয়ে আমাদের দেশে আবার একটি মহল নোংরা রাজনীতি শুরু করেছে। তারা যখন দালালদের খপ্পরে পড়ে নামমাত্র টাকার বিনিময়ে কিছু বাংলাদেশীসহ নৌকা বা জাহাজ সহযোগে অজানার পথে পাড়ি জমাচ্ছে এবং সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনিশিয়াসহ বিভিন্ন দেশের কোস্টাল পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে তখন তাদেরকে বাঙালি বলে অভিযোগ করা হচ্ছে।
অপরদিকে, বর্তমান সরকারের বিরোধী দলীয় জোটসমূহ অযথা অভিযোগ করছে, দেশে বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের অভাবেই এসব তরুণরা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অবৈধভাবে নৌ-সমুদ্র পথে বিভিন্ন দেশের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাচ্ছে। যা মোটেও ঠিক নয়।
পরিশেষে, বিদেশ গমণ ইচ্ছুক যুকবকদের জন্য বর্তমান সরকারের আমলেই ‘প্রবাসী কল্যাণ বাংক’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেখান থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশ গমন ইচ্ছুক যুবকেরা বৈধ পথেই কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন দেশে যেতে পারে। অযথা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি সমুদ্র পথে পাড়ি জমানোর কোন অর্থ হয় না। সম্প্রতি, জাতিসংঘ থাইল্যান্ডকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য অনরোধ করেছে। এখন দেখার বিষয়, থাইল্যান্ড জাতিসংঘের অনুরোধে বাস্তবে কতোটুকু সাড়া দেয়।
খোরশেদ আলম, লেখক ও গবেষক
অসাধারণ একটি সমসাময়িক লেখা।
অসাধারণ একটি সমসাময়িক লেখা। বর্তমানে তাদের অনেকে আবার দুর্নীতি করে বাংলাদেশের নাগরিকত্বও নিয়ে নিচ্ছে। বাঙালি গরীব মেয়েদের বিয়েও করছে। সামাজিক বিভিন্ন অপকর্মে তারা বহু আগে থেকেই লিপ্ত।
ধন্যবাদ। এসব রোহিঙ্গাদের অতীত
ধন্যবাদ। এসব রোহিঙ্গাদের অতীত ইতিহাসও ভাল ছিল না। তারা মায়ানমারেও বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত ছিল। @ তামান্না হায়দার
পড়ে অনেক কিছু জানলাম।
পড়ে অনেক কিছু জানলাম। সময়োপযোগী, তথ্যবহুল একটি লেখা। ধন্যবাদ লেখককে।
ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য
ধৈর্য সহকারে পড়ার জন্য আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ। @ মুন্সী মামুন
অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি পোস্ট।
অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি পোস্ট। ভাল লিখেছেন।
ধন্যবাদ আজিজুল সাহেব।
ধন্যবাদ আজিজুল সাহেব।
গঠনমূলক ও তথ্যসমৃদ্ধ একটি
গঠনমূলক ও তথ্যসমৃদ্ধ একটি লেখা। ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।
ধন্যবাদ আপনাকে। এটি ছিল
ধন্যবাদ আপনাকে। এটি ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট শাসনামলের একটি অপরিপক্ক সিদ্ধান্ত। যা এখন বাংলাদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। @ মুস্তাফিজুর রহমান