অনুরাধা ছিল অন্যরকম
অরুন্ধতী রায়
“ কমরেড অনু” – অনুরাধা গান্ধী
অনুরাধা গান্ধীকে যারা চিনত তারা প্রত্যেকেই এটা বলে। যাদের জীবনকে তিনি স্পর্শ করেছিলেন তারা প্রত্যেকেই এটা ভাবে।
১২এপ্রিল ২০০৮ । মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে তিনি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সম্ভবত এ রোগটা তিনি বাধিয়েছিলেন ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে । সেখানে তিনি একদল আদিবাসি মহিলাদের পাঠচক্রে পড়াচ্ছিলেন। এই মহা গনতন্ত্রে অনুরাধা গান্ধী হলেন একজন মাওবাদী সন্ত্রাসী যিনি যে কোন সময় গ্রেফতার হতে পারেন, নিহত হতে পারেন। তার শত শত সহকর্মীদের যে পরিনতি হয়েছিল। যখন এই সন্ত্রাসীর খুব জ্বর হয় তিনি রক্ত পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে যান। তিনি তার ডাক্তারকে একটি ভিন্ন নাম, একটি অচল ফোন নম্বর দেন। তাই ডাক্তার তার সাথে যোগাযোগ করতে পারেননি, তাকে বলতে পারেননি যে তিনি প্রাণঘাতী ম্যালেরিয়া ফলসিপারামে ভুগছেন। অনুরাধার অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলি অকেজো হতে শুরু করে । তিনি ১১এপ্রিল হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু অনেক দেরী হয়ে গেছে। সম্পুর্ন এক অপ্রয়োজনীয় ভাবে আমরা তাকে হারিয়ে ফেলি।
যখন তিনি মারা যান তার বয়স ৫৪ বছর। জীবনের ৩০ বছরেরও বেশি সময় তিনি আন্ডারগ্রাউন্ডে কাটান। একজন কমিটেড বিপ্লবী হিসেবে।
অনুরাধার সাথে দেখা করার সৌভাগ্য আমার হয়নি। কিন্তু যখন আমি তার স্মৃতি সভা গুলোতে যোগদান করি আমি এটা বলতে পারি তিনি এমন একজন মহিলা যিনি কেবল ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হননি, মানুষের গভীর ভালবাসাও পেয়েছেন। আমি কিছুটা অবাক হই যখন লোকেরা তার ত্যাগের কথা বলে। বলতে গেলে এটার মাধ্যমে তারা বুঝাতে চায় যে, তিনি তার মধ্যবিত্ত জীবনের আরাম আয়েশ ও নিরাপত্তাকে ত্যাগ করেছেন বিপ্লবী রাজনীতির জন্য। যাহোক আমার কাছে অনুরাধা গান্ধী এমনই একজন যিনি হাসিমুখে এক মামুলি ও ক্লান্তিকর জীবন বেছে নিয়েছেন তার স্বপ্নের জন্য। তিনি কোন ফেরেশ্তা বা মিশনারি নন। তিনি এমন এক উল্লসিত জীবনকে যাপন করেছেন যা ছিল সত্যিই কঠিন কিন্তু পরিপুর্ন।
তরুন অনুরাধা তার প্রজন্মের আরো অন্য অনেকের মতোই পশ্চিম বাংলার নকশাল আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হন। এলপিন্সটোন কলেজে ছাত্র থাকাকালে সত্তর দশকে মহারাষ্ট্রের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া দুর্ভিক্ষে তিনি গভীরভাবে আহত হন। দুর্ভিক্ষপীড়ীত মানুষদের সাথে কাজ করতে গিয়ে তার চিন্তাধারা আমুল পাল্টে যায়, যা তাকে বিপ্লবী রাজনীতির দিকে চালিত করে । মুম্বাইয়ের উইলসন কলেজে প্রভাষক হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৮২ সালের দিকে তিনি নাগপুরে চলে আসেন। পরবর্তী পাঁচ বছর তিনি নাগপুর, চন্দ্রপুর, অমরাবতী, জবালপুর ও ইয়াভাতমলে নির্মান শ্রমিক, কয়লা খনি শ্রমিক ও দরিদ্র জনগোষ্টিকে সংগঠিত করেন। এই সময়ে তিনি দলিত আন্দোলন নিয়ে তার জ্ঞানকে আরো শানিত করেন। ১৯৯০ এর শেষের দিকে তিনি বাস্তার চলে যান এবং দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলে পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মির(PLGA) সাথে তিন বছর কাটান। যদিও সে সময় তার শরীরে সক্লরৌসিস sclerosis ধরা পড়ে। এখানে তিনি গড়ে তুলেন ও বিস্তৃত করেন এক অসাধারন নারী সংগঠন সম্ভবত দেশের সর্ব বৃহৎ নারী সংগঠন – ক্রান্তিকারী আদিবাসী মহিলা সংগঠন যার আছে ৯০ হাজারেরও বেশি সদস্য। ক্রান্তিকারী আদিবাসী মহিলা সংগঠন সম্ভবত ভারতরাষ্ট্রের সবচেয়ে গোপন করা বিষয়গুলোর একটি। অনুরাধা সবসময় বলত যে তার জীবনের সর্ব সন্তুষ্টির সময় সেই বছরগুলি যা তিনি পিপলস ওয়ার ( বর্তমান সি পি আই মাওবাদী) গেরিলাদের সাথে দন্ডকারন্যে কাটিয়েছিলেন। অনুরাধার মৃত্যুর দুই বছর পর যখন আমি ঐ অঞ্চলে যাই ক্রান্তিকারী আদিবাসি মহিলা সংগঠন নিয়ে তার উতকন্টা ও উচ্ছাসের সন্ধান পাই, নারী ও সশস্ত্র সংগ্রাম নিয়ে আমার কিছু সহজ পুর্ব ধারনা নতুন করে ভাবতে বাধ্য হই। এই সংকলনের একটি লেখায় অবন্তী ছদ্মনামে অনুরাধা বলেনঃ
৮ মার্চ সমাগত। নতুন শতাব্দীর প্রভাতে ভারতের নারী ফ্রন্টে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটছে। মধ্য ভারতের জঙ্গলের গভীরে ও সমতলে , অন্দ্রপ্রদেশের পিছিয়ে পড়া গ্রামগুলোতে, পাহাড়ের আদিবাসিদের মধ্যে, বিহারের জঙ্গলে ও সমতলে এবং ঝাড়খন্ডে নারীরা সক্রিয়ভাবে সংগঠিত হচ্ছেন সামন্তীয় পিতৃতান্ত্রিকতার নিগড় ভেঙ্গে নয়া গনতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার জন্য। এটা দরিদ্র ভারতে কৃষক নারীদের মুক্তির আন্দোলন, বিপ্লবী নেতৃত্বের অধীনে নিপীড়িত কৃষকরা জনযুদ্ধে যোগ দিচ্ছেন। গত কয়েক বছর ধরে শত শত গ্রামে হাজার হাজার নারী ৮ মার্চ উদযাপনে জড়ো হয়েছেন। নারায়নপুরের রাস্তায় নারীরা নেমে এসেছেন বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগীতার বিরুদ্ধে। নারীরা তাদের শিশুদের নিয়ে তেহশিল শহর ও বাস্তার অঞ্চলের গ্রাম্য রাস্তায় মিছিল করেছেন শিশুদের জন্য স্কুল প্রতিষ্টার দাবীতে। তারা ধর্ষনের বিরুদ্ধে রাস্তা অবরোধ করেছেন, মদের ব্যবসা বন্ধ করতে পুলিশকে বাধ্য করেছেন। শত শত তরুন নারীরা নিপীড়িত জনগনের সৈন্যবাহিনিতে গেরিলা যোদ্ধা হয়েছেন। তারা একঘেয়ে ক্লান্তিকর জীবনের নিগড়কে ছুড়ে ফেলেছেন। ধুসর উনিফর্ম, জলপাই সবুজ টুপিতে লালতারা, কাঁধে রাইফেল, আত্ম বিশ্বাসে পরিপুর্ন এই তরুন নারীরা জানে যে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইটা মুলত আধা সামন্ততান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক ভারতের শাসক শ্রেনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সাথে গভীরভাবে যুক্ত। লুঠেরাদের তৃতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনীর সাথে লড়াইয়ের জন্য তারা নিজেদের সেভাবেই গড়ে তুলছে। এটা গ্রামীন ভারতের দরিদ্র থেকে দরিদ্রতম নারীদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জাগরণ ।এটা এমন এক দৃশ্যপট যা বুর্জোয়া মিডিয়ার অন্ধ চোখ , টিভি ক্যামেরার ঝলকানি থেকে অনেক দুরে উঠে দাঁড়িয়েছে। এগুলো সে সব পরিবর্তনকে চিহ্নিত করে যা বিপ্লবের জন্য মহা সংগ্রামে অংশগ্রহন করতে গিয়ে গ্রামীন দরিদ্র মানুষের জীবনে ঘটে গেছে।
কিন্তু এই বিপ্লবী নারী আন্দোলন রাতারাতি উঠে দাড়ায়নি, প্রোপ্যাগান্ডার ফলে এটা স্বতস্ফুর্ত ভাবে হয়েছে তাও নয়। এই নারী আন্দোলন স্বসশ্ত্র সংগ্রামের আগ্রগতির সাথে সাথে গড়ে উঠেছে। সাধারণ ধারনা যদিও এরকম নয়। ৮০ দশকের শুরুতে কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তুলেন। সামন্তীয় নিপীড়নের বিরদ্ধে এই সকল বীরত্বপুর্ন সংগ্রাম কৃষক নারীদের আত্ম বিশ্বাস যোগায় আরো অধিক পরিমানে, আরো অধিক সংখ্যায় সংগ্রামে অংশ গ্রহন করতে ও তাদের অধিকারের জন্য লড়াইয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে। নারীরা নির্যাতিতদের মধ্যে নির্যাতিত। দরিদ্র চাষী ও ভুমিহীন নারীরা যাদের কোন পরিচয়, কথা বলার অধিকার এমনকি কোন নাম পর্যন্ত ছিলনা তারাই নারী সংগঠনের কর্মী ও গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে সামনে চলে আসে। এভাবেই সশস্ত্র সংগ্রামের অগ্রগতি ও বিস্তৃতির সাথে সাথে নারীদের যুদ্ধোদ্যেগ ও নারী সঙ্গগঠনের বিস্তৃতি বাড়তে থাকে যা এক বিপ্লবী নারী আন্দোলনের উত্থান ঘটায়, যা আজ দেশের সবচেয়ে শক্তিশালী, সবচেয়ে দৃঢ নারী আন্দোলন। শাসক শ্রেনীসমুহের কুটচাল এই আন্দোলনকে কখনই স্বীকৃতি দেয়নি, এড়িয়ে গেছে। এই আন্দোলনের স্বীকৃতি ও যে কোন বার্তাকেই তারা যতটাই সম্বভ দমনের চেষ্টা করেছে।
অনুরাধার লিখাগুলি কিভাবে পড়তে হবে ? কিছুটা কঠিন বটে। সত্যি বলতে কি সেগুলো একটি সংকলন হিসেবে প্রকাশের উদ্দেশ্যে লেখা হয়নি। প্রথম পাঠে কিছুটা মৌলিক, কিছুটা পুনরাবৃত্ত ও কিছুটা শিক্ষণীয় মনে হতে পারে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পাঠের পরই কেবল আমি আলাদাভাবে বুঝতে পারি। এখন আমার মতে সেগুলো অনুরাধার নিজের নোট, নিজের প্রতি। কাটাকাটি, অযত্ন এবং তার দৃঢোক্তি নিয়ে প্রতিটি পাতাই যেন হ্যাণ্ড গ্রেনেড, আর এখানেই যেন মৌলিকত্ব। পড়ার মধ্যদিয়ে আপনি একজন মানুষের প্রজ্ঞার সন্ধান পাবেন যার কিনা হওয়ার কথা ছিল একজন স্কলার বা একাডেমিক কিন্তু তার সচেতনতা তাকে তা হতে দেয়নি যিনি কিনা বসে বসে চলমান ভয়ানক অবিচারকে তত্বায়ন করবেন। লেখাগুলি এমন একজন মানুষকে সামনে আনে যিনি তত্ব ও অনুশীলন এবং কর্ম ও চিন্তার মেলবন্ধন ঘটানোর জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। দেশের জন্য প্রকৃত ও প্রয়োজনীয় কিছু করার সিদ্ধান্ত নিয়েই তিনি বেচে ছিলেন। তিনি যেসকল মানুষের মধ্যে ছিলেন তাদেরকে, তার লেখায় অনুরাধা আমাদেরকে এবং নিজেকে বলতে চেষ্টা করেছেন কেন তিনি একজন মার্ক্সবাদী – লেনিনবাদী। তিনি বলার চেষ্টা করেছেন তিনি একজন লিবারেল এক্টিভিস্ট অথবা একজন রেডিকেল ফেমিনিস্ট বা একজন ইকো ফেমিনিস্ট বা একজন আম্বেদকরপন্থী কেন নন। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনি আমাদের এ সকল আন্দোলনের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের দিকে নিয়ে যান, বিভিন্ন আদর্শের চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন এবং এ সকল আদর্শের সুবিধা এবং সীমাবদ্ধতাগুলো তুলে ধরেন যেন একজন শিক্ষক ফ্লুরোসেন্ট মার্কার দিয়ে পরিক্ষার খাতার ভুল শুধরে নিচ্ছেন। এই অন্তর্দৃষ্টি ও পর্যবেক্ষণের মধ্যে কখনওবা সহজ স্লোগানের ভ্রান্তি যদিও আছে, সেগুলো জ্ঞানগর্ভ ও স্বর্গীয় স্বচ্চতায় পরিপুর্ন – এগুলো এমন ব্যক্তিই কেবল লিখতে পারেন যার রয়েছে তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক মনন এবং তিনি তার বিষয়টিকে জানেন পর্যবেক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থেকে, শুধুমাত্র ইতিহাস ও সমাজতত্ত্বের পাঠ্যবই থেকে নয়।
অনুরাধার সবচেয়ে বড় অবদান তার লেখা, তার অনুশীলিত রাজনীতি এবং লিঙ্গ ও দলিত ইস্যুর উপর তার কাজ। জাতপ্রথা সম্পর্কীয় চিরাচরিত মার্কসবাদী ব্যাখ্যা নিয়ে তিনি সমালোচনামুখর। তিনি তুলে ধরেছেন যে তার পার্টিও অতীতে এ ক্ষেত্রে ভুল করেছে জাতপ্রথা ইস্যুটাকে ঠিকমতো না বুঝার কারনে। তিনি দলিত আন্দোলনের সমালোচনা করেছেন কারন এটি একটি Identity Struggle এ সীমাবদ্ধ হয়েছিল, এটা ছিল সংস্কারবাদী, বিপ্লবী নয়। এই আন্দোলন ছিল অন্তঃসারশূন্য কারন এটি এক অন্তর্নিহিতভাবে অন্যায্য সমাজপরিমন্ডলে সুবিচার আশা করেছিল। তিনি বিশ্বাস করতেন পিতৃতান্ত্রিকতা ও জাতিপ্রথার সম্পুর্ন মুলোৎপাটন ব্যতীত কোন নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হতে পারেনা।
জাতিপ্রথা ও লিঙ্গ নিয়ে তার লেখায় অনুরাধা এমন এক মনন ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দেন যা সুক্ষ্ণাতিসুক্ষ্ণ পার্থক্য ও গোঁড়ামির উর্দ্ধে উঠে সত্যকে সত্য বলার মতোই নির্ভীক। তিনি নির্ভীক যে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন সেই ব্যবস্থার কাছে তেমনটিই তার কমরেডদের কাছে। হোয়াট এ উইমেন সি ওয়াজ !