আমার গাঁ ও বিদেশ গমন পর্ব : ১
:
মা বাবার মৃত্যুুর পর স্বজনদের প্রায় সবাই বলেছিল, আমি যেন ভারতে চলে যাই। এমনকি আমার জ্ঞাতীদের যারা ইতোমধ্যেই ভারতে গিয়ে বসতি গড়ে তুলেছে এবং তাদের জমি জিরাতের খোঁজখবর কিংবা বছর ভিত্তিক খাইখালাসি লিজ কিংবা গোপনে বিক্রয়ের জন্য ছমাস নমাসে একবার আসতো আমাদের গাঁয়ে, তারাও পরামর্শ দিয়েছিল, বাজারের সেলুনটা আর বাড়িটা বিক্রি করে বেনাপোল বর্ডার দিয়ে আমি যেন ভারতে চলে যাই। পাসপোর্ট ছাড়া কোন বর্ডার দিয়ে কিভাবে ঢুকবো তাও তারা বলে দিল আমায়! ওখানে গেলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের ধরে আমার জন্য রেশনকার্ড তথা ভারতীয় কাগজপত্রের জোগার করে দিতে পারবে তারা। এমনকি হুগলির কোন গাঁয়ে সেলুন ভাল চলবে, তারও নানাবিধ পরামর্শের পরও, কারো কথাতে কান দেইনি আমি। কারণ যে জল হাওয়াতে বড় হয়েছে আমি, যে নদীতে স্নান করে কাটিয়েছি পুরো কৈশোর আর যৌবন, তাকে ভুলে কিভাবে ভারত যাবো, তা কিছুতেই মনকে বোঝাতে পারছিলাম না আমি। তাই সবার অনুরোধ উপরোধ বাদ দিয়ে মাটি কামড়ে জলদাস গাঁয়েই পড়ে রইলাম আমি, বাজারের ছোট্ট সেলুনটির উপর ভরসা করে।
:
বিয়ে করিনি আমি। বলতে গেলে বিয়ে করতে পারিনি। কারণ আমার সহপাঠী ফিরোজার সাথে প্রেম হয়েছিল আমার স্কুলে থাকতেই। আমি যখন দশম শ্রেণিতে পড়ি, তখন বাবা মারা যান আমার। সেই থেকে বাজারের বাবার নেয়া সেলুনটিতে চুলদাড়ি কাটি আমি। সংসারের এটিই আয়ের উৎস। তাই আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। বন্ধুরা বললো, মেট্রিক পাশ করলেও ঐ চুলদাড়িই কাটতে হবে, তাই পাশ করলেও যা, না করলেও তাই। এবং স্কুলটা বাদ দিলাম ক্লাস টেনে উঠেই। পুরোদমে খাটলাম সেলুনে। কারণ ঘরে বিধবা মা। আর দূরগাঁয়ে বাবা বিয়ে দিয়ে গেছেন একমাত্র বোন দুলারীকে। তারও খোঁজ খবর নিতে হয়। পেশাতে দুলারীর জামাইও নাপিত। মাঝেমধ্যে আমাদের বাড়িতে আসে বেড়াতে। টাকা পয়সার চাহিদা থাকে বোন, তার সন্তানের জন্য। সুতরাং সেলুনের আয়তে মোটামুটি দিন চলে যায় আমার দিনগুলো কোনরকমে!।
:
ফিরোজাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। ফিরোজাও চেয়েছিল আমাকে। কিন্তু বাঁধসাধলো গ্রামের লোকজন। কোনক্রমেই হিন্দু ছেলে হয়ে মুসলমান মেয়ে বিয়ে করতে পারবো না আমি। কেবল একটা শর্তেই বিয়ে হতে পারে আমাদের। তাহলো, আমার মুসলমান হওয়া। কিন্তু জল কবুল, আগুন কবুল, মা কখনো মুসলমান হতে দেবেনা আমাকে। তাতে নাকি মৃত বাবাসহ আমরা সবাই নরকে যাবো। অথচ গ্রামের প্রতিবেশিরা বলে মুসলমান হলে ফিরোজাসহ আমি নাকি স্বর্গে যাবো। বুঝিনা কারো কথা। তাই যে অবস্থায় আছি, সেভাবেই পড়ে থাকলাম মাটি কামড়ে। দুতিনবার ফিরোজার বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু বাবাকে বলে সেও ফিরিয়ে দিয়েছে তা, আমার জন্য অপেক্ষা করছে ফিরোজা। ভারতে নাকি হিন্দু মুসলমান বিয়ে হলে সরকার থেকে নানাবিধ আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা দেয়া হয়। অথচ বাংলাদেশে এর কিছুই নেই। আহারে! বাংলাদেশে যদি ভারতের মত ওমন আন্তধর্মে বিয়ে হতো! মনে মনে চিন্তা করি!
:
চিন্তা করতে করতে দাড়িতে নতুন ব্লেডের পোচ দেই আমি অমল, সদ্য ওমান থেকে দেশে আসা দেলোয়ারের। তাগাদা দেয় দেলোয়ার তাড়াতাড়ি করতে। কারণ শ্বশুর বাড়ি যাবে সে। কথা তুলে দেলোয়ার। এখানে চুল কাটতে ৩০ টাকা আর সেভ করতে ১০ টাকা। কিন্তু ওমানে এ চুল কাটতেই বাংলাদেশের ৫০০ টাকা, আর সেভ করতে দুশ টাকা। অমল ওমান যাওনা কেন?
– ভাই গরিব মানুষ আমরা। তা ছাড়া হিন্দু। আরব দ্যাশে কি যাইতে পারি আমরা?
– ক্যান পারবা না? ওমানে বহুত হিন্দু আছে। সেলুনেতো সবই হিন্দু ইন্ডিয়ান!
– কন কি ভাই? মোছলমান নাই?
– আছে পাকিস্তানি দুই চাইরজন, বাদবাকি শতকরা নব্বই জনই হিন্দু!
– কিন্তুক আরব দেশে যাওনের লাখ লাখ টাকা পামু কই ভাই? তার চাইয়া এই বাজারেই ভাল আছি। দিন আনি দিন খাই। ঝামেলা নাই দিলু ভাই!
– অমল তুই একটা কাম কর। একটা পাসপোট বানা, আমি দেখি চেষ্টা কইরা তোর জইন্যো ভিসার কোন ব্যবস্থা করবার পারি কিনা!
– কয় টাকা লাগে পাসপোর্ট?
– মাত্তর সাড়ে ৩ হাজার।
– সেইটা না হয় জোগার করলাম কিন্তু বিদেশ যাওনের টাকা?
– তোগো বাড়িটার দাম লাখ দুই অইবে না?
– তা অইবে! তয় বাড়ি বেইচা বিদেশ? নারে ভাই?
– এক বছরে ঐ ছোট্ট চালার ঘরের বদলে দালান করতে পারবি!
– ভাই তা কি আর আমাকে কপালে আছে! আচ্চা তুই আগে পাসপোট বানা, বাকিটা আমি দেখুম কি করতে পারি!
– কিন্তুক ভিসা কিনতে যাইয়া অনেকে ফতুর, যাইতে পারেনা, জাল ভিসা, তারপর পথের ফকির।
– তুই চিন্তা করিস না। আমি যদি পারি তরে আসল ভিসা দিয়া নিমু। তুই আমাদের দ্যাশের মানুষ মানে প্রতিবেশি!
বলে যায় দেলোয়ার!
:
[এরপর জলদাস গাঁয়ের চলমান পর্ব : 75]
ফেসবুক মন্তব্য
শেয়ার করুনঃ