ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত নিয়ে উদ্বিগ্নতা বর্তমান সময়ের আলোচিত বিষয় । কিভাবে এই দুই তথাকথিত দেশের মধ্যে সংঘাতের শুরু তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে কয়েক দশক পার হয়ে যাবে । শুধু এখানে কয়েকটা পয়েন্ট আলোচনা করবো, যে কারণে বর্তমানে (সাম্প্রতিক) এই দুই দেশের মধ্যে সংঘাত চরমে রয়েছে ।
প্রথমে ইসরায়েল-ফিলিস্তিনের ভৌগলিক অবস্থান সম্পর্কে একটু জানা দরকার । ফিলিস্তিনকে দুটো ভাগে ভাগ কর হয়, গাজা ও ওয়েস্ট ব্যাংক । এবং দুটো রাজনৈতিক দুল এই দুটো অংশে রাজত্ব করে । এক অংশে ফাতাহ, অন্য অংশে হামাস ।
গাজা অংশ – নিয়ন্ত্রক হচ্ছে ‘হামাস’ (হামাসকে পশ্চিমা বিশ্ব জঙ্গি সংগঠন হিসাবে মনে করে) । এখানে ফাতাহ এবং ইসরায়েলের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই ।
ওয়েস্ট ব্যাংক – নিয়ন্ত্রক হচ্ছে ‘ফাতাহ’। এবং এই ফাতাহ’ হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ফিলিস্তিন সরকার) । এবং এই অংশে ইসরাইল সরকারের প্রভাব দেখা যায় ।
এবার ইসরাইলকে খুঁজতে গেলে আলাদা কোন দেশে যাওয়ার দরকার নেই । ফিলিস্তিনের সাথে মিলে মিশেই ইসরাইল রয়েছে । ম্যাপের নিচ দিয়ে হাটা শুরু করলে আপনি দেখবেন কখনো আপনি ইসরাইলে, আবার কখনো আপনি ফিলিস্তিনে আছেন ।
ওয়েস্ট ব্যাংক যে অংশে ফাতাহ সমর্থিত সরকার, এরা অনেকটাই হামাসকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে । এবং গাজা অংশে যে হামাস রয়েছে, এদেরকে বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় । ইসরায়েলের সাথে মাঝেমাঝে যে সংঘাত দেখা যায়, তা মূলত এই হামাস সমর্থিত গাজা অংশে । হামাসকে (গাজা) চারদিক দিয়ে ইসরাইল ও মিশর ঘিরে রেখেছে ।
বর্তমানে যে সংঘাত দেখা যাচ্ছে তার বেশিরভাগই বসতবাড়ি উচ্ছেদ অভিযানকে কেন্দ্র করে । সহজ করে বলতে গেলে, ইসরায়েলের নিজস্ব স্বতন্ত্রতা পেতে গেলে আগে নিজস্ব ভূখণ্ড তৈরি করতে হবে । এবং এই ভূখণ্ড তৈরির পদক্ষেপ হচ্ছে অল্প অল্প করে ফিলিস্তিনের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে ইসরায়েলের নাগরিকদের জায়গা করে দেওয়া । যার প্রধান কেন্দ্র হচ্ছে ‘জেরুজালেম’ । জেরুজালেম হচ্ছে পবিত্র ভূমি । এবং ৩ টা ধর্মের মানুষ এটাকে পবিত্র বলে মনে করে । মুসলিম, খ্রিস্টান এবং জীউসরা । এবং এখানে ধর্মকে দিয়ে সবকিছুকে ব্যাখ্যা করতে গেলে আরো কয়েক দশক আলোচনা হবে । ধর্ম মানুষের আবেগ ও বিশ্বাসের জায়গা । সেটা নিয়ে অন্যভাবে আলোচনা করা যায় ।
মূলত জেরুজালেম দুটো অংশে বিভক্ত । ওয়েস্ট জেরুজালেম এবং ইস্ট জেরুজালেম ।
ওয়েস্ট জেরুজালেম – এখানে ইসরায়েলের নাগরিক বেশি ।
ইস্ট জেরুজালেম – ফিলিস্তিনি নাগরিক বেশি ।
সমস্যাটা এই ‘ইস্ট জেরুজালেমে । এখানে ইসরায়েলের নাগরিক কম, ফিলিস্তিন বেশি । এবং সাম্প্রতিক দশকে ইসরাইল সরকার এই ইস্টে ইসরায়েলের নাগরিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে শুরু করেছে । কিন্তু কিভাবে সেই বৃদ্ধি হচ্ছে? সেই বৃদ্ধি হচ্ছে, ইস্ট জেরুজালেমে যেই ফিলিস্তিনিরা ছিল তাদেরকে আস্তে আস্তে নিজের বসতবাড়ি থেকে Eviction/উচ্ছেদ করা হচ্ছে । এবং ইসরায়েলের নাগরিকদের সেই জায়গা দেওয়া হচ্ছে ।
বর্তমান সমস্যা শুরু :
শেখ জারাহ, ইস্ট জেরুজালেমের একটি প্রধানত ফিলিস্তিনি পাড়া । এবং এই পাড়া থেকে ফিলিস্তিনিদের ঘর ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দেয় ইসরাইল সরকার । মূলত এটাই বর্তমান সংঘাতের মূল ইস্যু । এছাড়া ঠিক এসময়েই ইস্ট জেরুজালেমে কিছু উগ্রবাদী জীউস সমর্থকেরা ‘Death to Arabs’ নামে স্লোগান দিয়ে মিছিল বের করে । যা আরব মুসলিম ও জীউসদের মধ্যে মানসিক সংঘাত তৈরিতে সহায়তা করে । এবং এই আগুনে ঘি ঢেলে দেয় দুজন ইসরাইলি রাজনীতিবিদ । যারা পুরো জেরুজালেম শহরকে ইসরায়েলের অংশ বলে রাজনৈতিক বক্তব্য দেয় । ফলে পরিস্থিতি আরো ভয়ংকর হয়ে ওঠে ।
৭ মে, এই পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনিরা আন্দোলন শুরু করে । সেখানে ইসরাইলি পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয় । এবং দুপক্ষের মধ্যেই হতাহতের ঘটনা ঘটে ।
১০ মে, আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে ইসরাইলি পুলিশ পবিত্র আল আকসা’ মসজিদে প্রবেশ করে । এবং সেখানে পুলিশ রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে । পুলিশের বক্তব্য হচ্ছে, মসজিদে আন্দোলনকারীরা লুকিয়ে ছিল যাদের ধরতে মসজিদে প্রবেশ করে পুলিশ, যদিও এগুলো ডিফিকাল্ট পুলিশিও বক্তব্য ।
এবং আল আকসা’ মসজিদে হামলার ঘটনায় হামাস এবারে নড়েচড়ে বসে । হামাস হুমকি দেয়, ইসরাইলি পুলিশকে মসজিদ থেকে না সরালে হামাস হামলা করবে ইসরাইলে। -এর কয়েক ঘন্টার মধ্যে হামাস রকেট হামলা চালায় ইসরায়েলে । এর ফলশ্রুতিতে ইসরাইলও Air strike শুরু করে দেয় ফিলিস্তিনে বিশেষ করে হামাস নিয়ন্ত্রিত এলাকায়।
এগুলো হচ্ছে বর্তমান সময়ের যে সংঘাত তার একটা নথি । দুপক্ষেরই নিজেদের লজিক আছে । ইসরাইল বলে হামাস আগে রকেট ছুড়েছে তাই আমরাও জবাব দিয়েছি । হামাস বলে ইসরাইল আমাদের আল আকসায় ঢুকেছে তাই হামলা করেছি । আপনি এখন যে পক্ষের চোখ দিয়ে দেখবেন, সেই পক্ষকেই আপনার সঠিক বলে মনে হবে । এক্ষেত্রে সবার নিজস্ব মতামত রয়েছে ।
তবে হ্যাঁ, কে ঠিক আর কে ভুল তা নির্ধারণের আগে কিছু বেসিক বিষয় জানা দরকার । যেমন: ইউরোপীয় কমিশনের মতে, ইসরাইল যে ভূমি উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে তা অবৈধ । জাতিসংঘের মতে, যে আইনের কথা ইসরাইল বলছে ভূমি উচ্ছেদের ক্ষেত্রে সেটা বৈষম্যমূলক এবং যে ইসরাইলি নাগরিকদের ফিলিস্তিন অংশে বসতবাড়ি দেওয়া হচ্ছে তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের বিরুদ্ধ ও এটা যুদ্ধাপরাধ ।
অর্থাৎ আন্তর্জাতিক আইনের মতে, ইসরাইল যে পন্থা অবলম্বন করছে তা সম্পূর্ণ বে-আইনী । কিন্তু অন্যদিকে হামাস’ যে রকেট প্রতিনিয়ত ইসরায়েলের দিকে ছুড়ে দেয় সেটাও সঠিক লড়াই হতে পারেনা । কারণ এখানে দুপক্ষের সংঘাতে হাজারো মানুষ প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে । হাজারো শিশুর ভবিষ্যত ধ্বংস হচ্ছে এই যুদ্ধে । মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, চোখের বদলে চোখ নিতে গেলে পৃথিবীটাই একদিন অন্ধ হয়ে যাবে । অর্থাৎ যুদ্ধ-পাল্টা যুদ্ধই পৃথিবীর ধ্বংস বয়ে আনবে ।
তবে গ্রাউন্ড রিয়ালিটি ভয়ংকর । ফিলিস্তিনের উগ্র মনভাবাপন্ন কিছু মানুষ মনে করে ইসরাইল terrorist, আবার ইসরায়েলের উগ্রপন্থীরা মনে করে ফিলিস্তিনিরা terrorist. এভাবেই এদের সংঘাত বয়ে চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে । দুদেশের এই সম্পর্ককে সাপে-নেউলে সম্পর্ক বললেও অবাক হওয়ার নেই ।
শেষ করবো, তবে great power comes with great responsibility’ কথাটা অন্তত ইসরাইলের উচিত মেনে চলা । ক্ষমতা থাকলে সেই ক্ষমতাকে সঠিকভাবে এবং দায়িত্বশীল হয়ে প্রয়োগ করতে হয় । এখন হামাসকে শিক্ষা দিতে গিয়ে তো পুরো ফিলিস্তিনকেই ধ্বংস করে দেওয়া বৈধ কাজ নয় । সেখানে অনেক নিরীহ মানুষ মারা যাচ্ছে যারা হয়তো সুন্দর একটা দিনের স্বপ্ন দেখেছিল ।
প্রকাশিত লেখা ও মন্তব্যের দায় একান্তই সংশ্লিষ্ট লেখক বা মন্তব্যকারীর, ইস্টিশন কর্তৃপক্ষ এজন্য কোনভাবেই দায়ী নন। লেখকের এবং মন্তব্যকারীর লেখায় অথবা প্রোফাইলে পরিষ্কারভাবে লাইসেন্স প্রসঙ্গে কোন উল্লেখ না থাকলেও স্ব-স্ব লেখার এবং মন্তব্যের সর্বস্বত্ব সম্পূর্ণভাবে সংশ্লিষ্ট লেখক বা মন্তব্যকারী কর্তৃক সংরক্ষিত থাকবে। লেখকের বা মন্তব্যকারীর অনুমতি বা সূত্রোল্লেখ বা কৃতজ্ঞতা স্বীকার ব্যতিরেকে লেখার বা মন্তব্যের আংশিক বা পূর্ণ অংশ কোন ধরনের মিডিয়ায় পুনঃপ্রকাশ করা যাবে না।